ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি):
দুটো আর্টিকেল দেয়া হলো :
আর্টিকেল-১
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকৃতির নিজস্ব কোনো সৃষ্টি
নয়। বরং জল-স্থল, চন্দ্র-সূর্য, আলো-বাতাস তথা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে যা কিছু ঘটে
সেগুলো মহান আল্লাহর সূক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশ। দুর্যোগ-দুর্ঘটনাও তারই ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ।
বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মানুষের কৃতকর্ম। সমাজে অন্যায়-অনাচার বেড়ে গেলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের
আশঙ্কা থাকে বেশি। রাসুল [সা.] হাদিসে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও উম্মতের ওপর দুর্যোগের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন। তিনি
দোয়া করেছেন যেন তার উম্মতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে এক সঙ্গে ধ্বংস না করা হয়। কোনো
প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে রাসুল [সা.] বিচলিত হয়ে পড়তেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন।
বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতেন এবং অন্যদেরও তা করার নির্দেশ দিতেন। ঝড়-তুফান শুরু
হলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। নফল নামাজে দাঁড়িয়ে
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাতেন। রাসুল [সা.]-এর এই আমল দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের
মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী তা জানতে পারি। আমাদের উচিত নিজেদের আমল-আখলাক বিশুদ্ধ করে
খাঁটি মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।
আর্টিকেল-২
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য সতর্কতামূলক বার্তা। আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো তাঁর বিধানের সীমা লঙ্ঘনের কারণে মানুষের প্রতি দুর্যোগ চাপিয়ে দেন। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের ঈমানের পরীক্ষা নেন। এ ব্যাপারে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, সম্পদ, প্রাণ ও ফসলের হানি করে পরীক্ষা করব। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন, যাদের ওপর বিপদ আসলে তারা বলে, আমরা আল্লাহর জন্যই, আমরা তার দিকেই ফিরে যাব। তাদের ওপর তাদের রবের ক্ষমা ও রহমত অবতীর্ণ হয়। আর তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১৫৫-১৫৭)
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুমিনের জন্য আল্লাহর পরীক্ষা। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে তাঁর সাহায্য কামনা করা এবং ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি তার ইবাদাত-বন্দেগি করে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা করা।
হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনে, ‘মুমিনের বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যের! তার প্রতিটি কাজই কল্যাণকর। যদি তারা (মুমিন বান্দা) সুখে থাকে তবে শুকরিয়া আদায় করে, যার ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর সে বিপদে পড়লে ধৈর্য ধরে, তাও তার জন্য মঙ্গলজনক হয়।’ (মুসলিম)
কুরআনে আরো এসেছে, ‘গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সুরা সাজদা : ২১) এ আয়াতের তাফসিরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ছোট শাস্তি হলো দুনিয়ার বিপদাপদ, রোগব্যাধি, মৃত্যু এবং তাদের ওপর নেমে আসা অন্যান্য মুসিবত, যা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যাতে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রসঙ্গে
সাধারণত মনে করা হয়, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এসবই হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খেয়ালী প্রাকৃতিক কারণে সময় সময় এসব হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন জাগে, এ বিপর্যয় কেন হলো? এমন ভয়াবহ বিপদের কারণ কি? তথাকথিত প্রকৃতিই কি এর জন্য দায়ি? এতে মানুষের অন্যায়-অনাচারের কোনো প্রতিক্রিয়া কি নেই?
বিজ্ঞান এ প্রশ্নের জবাবে নীরব। জ্ঞান অর্জনের আর সকল সূত্রই এ পর্যায়ে অকেজো। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ সম্পর্কে নীরব নয়। যেহেতু কুরআন আল্লাহ পাকের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব, যেহেতু এ মহান গ্রন্থ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যেহেতু পবিত্র কুরআনই সর্বকালীন মানুষের মুক্তির চিরস্থায়ী মহাসনদ, তাই পবিত্র কুরআনেই রয়েছে এ প্রশ্নের জবাব।
পবিত্র কুরআন আমাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় কেন আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভয়াবহ বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি। কেন বারবার নেমে আসে ধ্বংস মানুষের জীবনে। এ পর্যায়ে আল-কুরআনে সর্বপ্রথম যে নীতি নির্ধারণীর কথা বলেছে তা এই, ‘‘এবং (হে রাসূল।) আপনার প্রতিপালক সে পর্যন্ত কোনো লোকালয় ধ্বংস করেন না যে পর্যন্ত না তার সদর স্থানে কোনো রাসূল প্রেরণ করেন। যে সেই জনপদবাসীর নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে, আর যেসব জনপদের অধিবাসীরা অত্যাচারী, আমি শুধু তাদেরই ধ্বংস করি।’’ এতে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, যদি কোনো স্থানের মানুষ জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত হয়, তাদের প্রতিই আপতিত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি ধ্বংস নেমে আসে। আল-কুরআনে এসব বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে কিন্তু কুরআন খুলে দেখার লোক নেই, সতর্ক হতেও কেউ রাজি নেই।
মূলত পৃথিবীর ইতিহাসে রয়েছে এর বহু প্রমাণ যে, আল্লাহ তায়ালার নাফরমান জাতিগুলোকে তিনি জগতের বুকে অশান্তি সৃষ্টি করার শাস্তিস্বরূপ ধ্বংস করে দিয়েছেন চিরতরে। পবিত্র কুরআনে পূর্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন, যেন অনাগত ভবিষ্যতের মানুষ এ ঘটনাবলীর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করে। যারা তাদের অন্যায় আচরণের দরুন আল্লাহ কোপগ্রস্ত হয়েছে আগামী দিনের মানুষ যেন তাদের অনুসরণ করে এমনিভাবে বিপদগ্রস্ত না হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : ‘‘তারা কি দেখে না যে তারা প্রতিবছর একবার অথবা দু'বার বিপদগ্রস্ত হয়, অতঃপর তারা তওবা করে না এবং উপদেশও গ্রহণ করে না।’’ [তওবা ঃ ১২৬] এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক বছর দেশে যে বন্যা, মহামারি, ঝড়, তুফান, টর্নেডো এবং এমনি আরো বিপদাপদ আসে এ সমস্ত বিপদ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো আমাদেরকে পবিত্র করে তোলা। আমাদেরকে তওবা করার সুযোগ দেয়া। মোট কথা, এর পশ্চাতেও রয়েছে এক মহান উদ্দেশ্য, তা হলো, আমাদের সংশোধন। এতে রয়েছে আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত আর এ দুর্যোগ প্রকৃতির খেয়াল-খুশিমতো নয়, বরং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী আসে। তাই পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন : ‘‘আল্লাহ তায়ালার হুকুম ব্যতীত কোনো বিপদই আসে না। (অর্থাৎ সকল বালা-মুসিবত বিপদাপদ একমাত্র সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার আদেশানুযায়ী এসে থাকে) এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে সে তার অন্তরকে পথ প্রদর্শন করে, আর আল্লাহ সব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। [তাগাবুন ঃ ১১]
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ করেন ঃ ‘‘মানুষের কর্মের পরিণতিস্বরূপ স্থলে ও সমুদ্রে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যাতে করে মানুষ ফিরে আসে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছুটা স্বাদ ভোগ করাতে চান।’’ [রুম ঃ ৪১] অর্থাৎ মানুষের অন্যায় আচরণের কারণে আল্লাহর অবাধ্যতা এবং নাফরমানির দরুনই আজ পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে এবং চতুর্দিকে বিপদের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। বস্তুত আমাদের জন্য এ বিপদও কল্যাণকর হতে পারে যদি আমরা এর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করি এবং আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করি। শুধু এভাবেই আমরা পরকালের আজাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারি। আর আল্লাহও চান যেন আমরা ইহকাল ও পরকালের আজাব থেকে মুক্তি লাভ করি।
আল্লাহ ইরশাদ করেন : ‘‘যদি তোমরা সৎ কাজ কর তবে তা তোমাদেরই উপকারার্থে, এর ফল তোমরাই ভোগ করবে। পক্ষান্তরে যদি তোমরা অন্যায় কার্যে লিপ্ত হও তবে তার শাস্তিও তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে।’’ [বনি ইসরাইল ঃ ৭]
অতএব যখনই পৃথিবীতে ঝড়-তুফান, ঘূর্ণিবার্তা, বন্যা এবং এ ধরনের বিপদ আসে, তখনই পরকালের মুক্তিকামী মানুষ সাবধান হয়, অন্যায় পথ পরিত্যাগ করে ন্যায়পথের অনুগামী হয। অন্যায়-অনাচার, জুলুম-অত্যাচার, পাপ-পংকিলতায় পূর্ণ জীবন, আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা এবং নির্লজ্জতা, অশ্লীলতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেমে আসে আসমানী-যমিনী বালা-মুসিবত, ভয়াবহ ঝড়-তুফান, টর্নেডো এবং বন্যা দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া অগ্নিকান্ড মহামারি, ভূমিকম্প আর ধ্বংস। তখন সর্বাগ্রে আমাদের একান্ত কর্তব্য হলো, তওবা এস্তেগফারের পথ অন্বেষণ করা, কৃত অন্যায়ের জন্য আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করা, আল্লাহর দরবারে অনুতপ্ত চিত্তে অশ্রুপাত আমাদের পাপ মোচনের জন্য সহায়ক হতে পারে।
Writer: ইবনে সাইজ উদ্দীন
https://www.dailysangram.com/post/100364-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A5-%E0%A6%86%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%87
Comments
Post a Comment