করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রুখতে চীনের কৌশল
সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চললেও ফুজিয়ান প্রদেশসহ গোটা চীন কীভাবে ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব থেকে মুক্ত? আমাদের সাথে এদের পার্থক্যটা তাহলে কোথায়? হ্যাঁ, পার্থক্য আছে এক জায়গাতে, সেটা হলো, আমজনতার ভিতরে। এরা চাইনিজ আর আমরা বাঙালি। এরা নিয়ম শৃঙ্খলা না ভেঙে সুচারুভাবে নিয়ম মেনে চলতে জানে আর বাঙালি এদের উল্টো। আমাদের দেশে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনী নামিয়ে জনগণের মাস্ক পরাতে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা লাগে। আর এখানে জনগণ নিজ থেকেই সেগুলো করে। আমাদের দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল জরিমানা করা লাগে কিন্তু এদের কাছে মোবাইলের একটা সচেতনাতামূলক খুদে বার্তাই যথেষ্ট। তাহলে এককথায় বলতে পারি, সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া কিছু রুটিন মাফিক নিয়ম-নীতি মেনে চললেই চীনাদের মতো সুফল শুধুমাত্র আমরা না, বিশ্বের যেকোন দেশ পেতে পারে। আসুন, এখন এদের নিয়ম-নীতি নিয়ে একটু আলোকপাত করি।
চীনের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সেই পূর্বের নিয়ম বহাল আছে। চীনে কিছু কিছু প্রদেশে মাঝেমধ্যে ২/১ জনের নতুন করে সংক্রমণ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যে সব প্রদেশে এই সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়, সেসব প্রদেশ থেকে অন্যান্য প্রদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কড়াকড়ি থাকে। কেউ সেসব প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করলে তাকে বাধ্যতামূলক নিজের করোনা টেস্ট করাতে হবে। এজন্য ওই প্রদেশ থেকে ফেরা সবাইকে বিমানবন্দর বা ট্রেন স্টেশন থেকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে নমুনা দিয়ে আসার পরে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে থাকতে হবে আইসোলেশানে। একদিন পরে পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ পাওয়ার সাথে সাথে এই আইসোলেশানের মেয়াদ শেষ হবে অর্থাৎ তাকে তার নিজ ঠিকানায় যেতে দেওয়া হবে। আর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে ফলাফল পজেটিভ হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ তখন খুবই সজাগ হয়ে যায়। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি তার মোবাইল ট্র্যাকিং করার মাধ্যমে বিচরণের সর্বত্র চিরুনি তল্লাশি করা হয়। অর্থাৎ সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সমস্ত ব্যক্তিদের খুঁজে করোনা পরীক্ষা করানো হয়। সেক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে যে, তাকে বহনকৃত বিমান, ট্রেনের নির্দিষ্ট বগি বা যেকোন পাবলিক পরিবহনের সমগ্র যাত্রী খুঁজে বের করে তাদের করোনা পরীক্ষা করানো। চীনাদের কাছে কতবেশি জনের পরীক্ষা করা হলো সেটা কোনো বিষয় না। এদের রেকর্ড আছে, দশ দিনে উহান শহরে সকল জনগণের (এক কোটি বিশ লাখ) করোনা পরীক্ষা করানোর। মূল বিষয় হলো ভাইরাসের সংক্রমণের উৎপত্তিস্থল উদঘাটন করা এবং বিস্তার রোধে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে কীভাবে প্রতিটা মানুষের চলাচলকে কর্তৃপক্ষ তদারকি করে সেই প্রশ্নটা সবার মনে জাগাটাই স্বাভাবিক। এখন আসি সেই সম্পর্কে। এখানে প্রতিটা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মোবাইল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেকের মোবাইল নাম্বারের বিপরীতে নির্দিষ্ট এই মোবাইল অ্যাপে সবাই তাদের প্রতিদিনকার চলাফেরা আপডেট দেওয়া বাধ্যতামূলক। অ্যাপটিতে নিজেদের স্ব স্ব স্বাস্থ্য কোড পরীক্ষার জন্য একটি কিউ আর কোডের ব্যবস্থা আছে। কিউ আর কোডটি যখন তখন যে কেউ অ্যাপে প্রবেশ করে পরীক্ষা করতে পারে।
কিউ আর কোডটিতে প্রবেশ করলে যথাক্রমে সবুজ, হলুদ এবং লাল এই তিন রঙ বিশিষ্ট কোড দেখায়। সবুজ কোড দেখানোর অর্থ বিপদ মুক্ত অর্থাৎ তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না থাকায় তার কোথাও ভ্রমণে বাঁধা নেই। এরপর আছে হলুদ কোড। কেউ কোনো সংক্রমিত এলাকা থেকে এলে তার কোডটি হলুদ দেখায়। সেক্ষেত্রে তাকে করোনা পরীক্ষা করানোর পরে ফলাফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই কোডটি হলুদ থাকে। টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এলে সবুজ এবং পজেটিভ এলে লাল হবে। লাল হওয়ার অর্থ তাকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে যতদিন পর্যন্ত না করোনা থেকে তিনি মুক্ত হন। সারাদিনে জনগণ তাদের বসবাসকৃত শহরের ভিতরে থাকলে অর্থাৎ তাদের বসবাসের এলাকা থেকে দূরে কোথাও ভ্রমণ না করলে কিউ আর কোডটি সবুজ রঙ দেখায়। কোডগুলোর রং কী ধরনের হবে সেটা সংক্রমিত এলাকা চিহ্নিত করে তবেই কর্তৃপক্ষ মোবাইল নেটওয়ার্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করে।
এখন আশা করি সবার কাছে পরিষ্কার কীভাবে চীনা প্রশাসন খুব সহজেই সবার চলাফেরাকে মনিটরিং করে। কেউ কোথাও ভ্রমণ না করলেও উক্ত অ্যাপটি মোবাইলে ব্যবহার করে সবাইকে প্রতিদিনকার নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য যেমন আজ আদৌ বাইরে গিয়েছিল কিনা, গেলে কোথায়, আজ নিজের শরীরের তাপমাত্রা কত, সাধারণ কোনো কফ বা সর্দি আছে কিনা, বিগত ১৪ দিনে আইসোলেশানে ছিল কিনা, বিগত ১৪ দিন করোনা পজেটিভ কোনো ব্যক্তির সাথে মেলামেশা বা সাক্ষাৎ করেছে কিনা ইত্যাদি তথ্য প্রতিদিন রাত ১২টার আগে পূরণ করে সাবমিট করা লাগে। অনেকের কাছে এসব শুনে বেশ ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু না এগুলো একেবারেই সহজ। ১১ থেকে ১২টা প্রশ্ন আছে অ্যাপটিতে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরের অপশনে হ্যাঁ অথবা না অপশন আছে। হ্যাঁ সিলেক্ট করলে দুই এক কথা লেখা লাগে আর না সিলেক্ট করলে কিছুই লেখা লাগে না। সেজন্য খুবই দ্রুত এটা হয়ে যায়। আর এটা সাবমিট করতে সর্বোচ্চ চল্লিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট সময় লাগে।
N:B: দাজ্জাল সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের উপর নজরদারি করবে।
Comments
Post a Comment