রাশিয়া কেন আলাস্কা বিক্রয় করেছিলো? এবং সমতল পৃথিবীতে এসবের ব্যাখ্যা:
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা পরাশক্তি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি স্থলজ আয়তন ও জনসংখ্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ যার আয়তন ৯৮,২৬,৬৭৫ বর্গকিলোমিটার। একটি ফেডারেল জেলা ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া (District of
Columbia) ও ৫০ টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত এই বিশাল আয়তনের দেশ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্যটি
হলো আলাস্কা যার আয়তন ৫,৮৬,৪১২ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে আমেরিকা ক্রয়ের পূর্বে এই বিশাল ভূখন্ড রাশিয়ার অর্ন্তভূক্ত
ছিলো। রাশিয়া ও আলাস্কার মাঝে বেরিং প্রণালী অবস্থিত। আলিউট আলিয়েস্কা ভাষা হতে আলাস্কা শব্দটি নেয়া যার অর্থ বিশাল বা মহান দেশ বা ভূখন্ড। চলুন জেনে নেই ঠিক কি কারণে রাশিয়াকে আলাস্কা বিক্রয় করতে হয়েছিল।
আলাস্কা বিক্রির
কারণ
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের
অক্টোবর মাসে তুরস্কের নিয়ন্ত্রিত দারদানেলিস প্রণালী দিয়ে যুদ্ধ জাহাজ চলাচলের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তুরস্কের খ্রিষ্টানদের রক্ষার অজুহাতে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের
তুর্কি এলাকায় রাশিয়া আক্রমণ চালায় যার ফলাফল হিসেবে ক্রিমিয়ার (বর্তমানে ইউক্রেনের অর্ন্তভূক্ত) যুদ্ধের সূচনা। এই যুদ্ধে রাশিয়া ও বুলগেরিয়ার বিপক্ষ শক্তি ছিলো ফ্রান্স, ব্রিটেন ও তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য। তিন বছর ব্যাপি চলমান এই যুদ্ধে রাশিয়া ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ
হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে রাশিয়ার সাথে মিত্রবাহিনীর
এক সন্ধিচুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অনুসারে রাশিয়া তাদের অধিকৃত কিছু এলাকা তুরস্কের হাতে ছেড়ে দেয়। এই সময় অন্যান্য দেশের যুদ্ধ জাহাজের মতো রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজের ওপরও কৃষ্ণ সাগরে চলাচলে নিষেধাজ্ঞার
সম্মুখিন হয়। অপরদিকে তুরস্কের খ্রিষ্টানদের
জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে মৈত্রী দেশগুলো সম্মত হয়। যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে রাশিয়া অর্থনৈতিক ভাবে খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাশিয়ার কাছে প্রচুর পরিমাণে বরফে ঢাকা বনভূমি এবং খুব অল্প পরিমাণ অবশিষ্ট অর্থ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
যুদ্ধের পর অর্থনৈতিক দৈনদশা কাটিয়ে উঠতে রাশিয়ার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিলো। তৎকালীন মূল অর্থনৈতিক পরাশক্তি গুলো রাশিয়ার বিরোধি শিবিরে থাকার কারণে কোন দেশের নিকট থেকে সহজ শর্তে অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়ার রাস্তাটাও ছিলো বন্ধ। এছাড়া যুদ্ধ বিদ্ধস্থ একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছে দুরবর্তী একটি অঙ্গ রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ছিলো কষ্টকর বৈকি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার উপর আবার স্থাণীয় উপজাতিগুলি ছিলো অত্যন্ত অপ্রতিরোধ্য। ফলে একাধিক বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও সহিংসতা ঘটার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিধানগুলো লঙ্ঘনের মতো ঘটনা গুলো ছিলো অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার তুন্দ্রা অঞ্চলের অর্ন্তগত হওয়ায় সেখানে বসবাস এবং জীবন ধারণও সহজতর ছিলো না। তৎকালে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিলো প্রকট। সেকারণে রাশিয়াকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে আলাস্কা বিক্রয়ের চিন্তা করতে বিন্দুমাত্র
ভাবতে হয়নি। আবার তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করলেও রাশিয়া যে নিজেদের স্বার্থেই আলাস্কা বিক্রয় করেছিলো একথা পুরোপুরি যুক্তি যুক্ত বলেই মনে হয়।
বিক্রির প্রস্তাব
ও বিক্রি
চুক্তি
রাশিয়া প্রথমে ব্রিটিশ এবং পরে আমেরিকাকে আলাস্কা ক্রয়ের আমন্ত্রণ জানায়। আলাস্কার পাশে অবস্থিত ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি উপনিবেশ থাকা সত্ত্বেও দূর্বল রাশিয়ার কাছ থেকে অলাস্কা কিনে নেয়ার কোন আগ্রহ দেখায়নি কারণ অর্থ অপচয় না করে আলস্কা দখল তখন তাদের কাছে ইচ্ছা আর সময়ের ব্যাপার ছিলো মাত্র। আবার “ক্যালিফোর্নিয়া
Gold Rush” থেকে ধারনা করা হয় যদি আলাস্কা তে স্বর্ণ পাওয়া যায় তাহলে হয়তো জোড়পূর্বক আমেরিকা-কানাডা গ্রাস করে ফেলবে এই আলাস্কাকে। ব্রিটিশ যুদ্ধংদেহী দূরভিসন্ধিমূলক
মনোভাব এবং লেজের কাছে কানাডা-আমেরিকার স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে শত্রুর কাছে অঞ্চলটিকে হারানোর চেয়ে কোনো নিরপেক্ষ দেশের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টিই ছিলো রাশিয়ার কাছে সেরা বিকল্প।
তৎকালীন রুশ সম্রাট ২য় আলেকজান্ডার সর্বপ্রথম আমেরিকার কাছে
আলাস্কা বিক্রয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তবে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ সম্পর্কিত ব্যাপার নিয়ে ওয়াশিংটন তখন প্রচুর চিন্তিত থাকায় আমেরিকা চুক্তি থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে রুশ সম্রাটের ছোট ভাই এর চিঠির পর বরফ গলতে থাকে এবং আমেরিকা ১৮৫৯-৬০ সালে দরকষাকষি শুরু করে। একজন সিনেটর আলাস্কা এর মূল্য হিসাবে ৫ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করেন রাশিয়া কে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বিউকানান
(James Buchanan) এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং আমেরিকান গৃহযুদ্ধকালে তাঁর নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতে শুরু হয় এবং নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত আমেরিকা
আলাস্কা নিয়ে কোন চুক্তি করা থেকে আগের মতোই বিরত থাকে। অন্যদিকে রাশিয়া রথচাইল্ডস (Rothschilds) এর কাছ থেকে বাতসরিক ৫% সুদে যে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড বিশুদ্ধ মুদ্রা ধার নিয়েছিলো তা পরিশোধ করতে অপারগ হয় এবং পেরু ও চিলি এর সাথেও বিবাদ শুরু হয়। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ তে
“Union” এর সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়।
উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তি কমে আসার পরে রাশিয়ান সম্রাট আবারো আলাস্কা বিক্রয় বিষয়ে আমেরিকা তে রাজদূত প্রেরণ করেন। রাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম সেওয়ার্ড ( William Seward) এর নেতৃত্বে সারারাত ধরে আলোচনা ও দরকষাকষি চলতে থাকে রুশ সাম্রাজ্য ও আমেরিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে। সারারাত আলোচনা শেষে ১৮৬৭ সালের ৩০শে মার্চ,
ভোর ৪ টায় মাত্র ৭.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আলাস্কা ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অবশেষে
১৮ই অক্টোবর ১৮৬৭ সালে সদ্যবিক্রিত আলাস্কা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আমেরিকান আলাস্কাতে বসবাসরত কয়েক হাজার রাশিয়ান স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও কিছু নাগরিক আলাস্কাতেই থেকে যায়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমেরিকা অর্থনৈতিক সাফল্যের দেখা পায়। মৎস সম্পদ, পশম বাণিজ্য সীল এর চামড়া ও চামড়া বাণিজ্যের পাশাপাশি আলাস্কা তে প্রচুর পরিমাণে বনজ সম্পদ (গাছপালা) এবং প্রাণীজ সম্পদের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ গুলোও গুরুত্ব পায়। তাছাড়া আবিষ্কৃত হয় একাধিক Gold mine (স্বর্ণখনি) ও তেলকুপ/ তেলের খনি। দেখা যায় আলাস্কাকে কেনার ৫০ বছর পরে আমেরিকানরা ক্রয়কৃত মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০০গুণ বেশি মূল্য ফেরত পায়।
কাজেই কথতা বলা অধিক যুক্তিযুক্ত তৎকালীন প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার আলাস্কা বিক্রয় সময়োপযোগি
সিদ্ধান্ত হলেও ভবিষ্যতের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির অঙ্কটাই বেশি পক্ষান্তরে যা আমেরিকার লাভের পাল্লাকে করেছে অনেক ভারি।
©
R:M: এবার আসুন দেখি সমতলে বিছানো পৃথিবীতে আলাস্কা, আমেরিকা, রাশিয়া ও বেরিং প্রণালীর সম্পর্ক কিভাবে হয়? জাতিসংঘের সমতল পৃথিবীর ম্যাপটি ভালো করে খেয়াল করুন (যদিও আমরা এটাকে চূড়ান্ত ম্যাপ মনে করিনা)। এই অঞ্চলগুলো (আলাস্কা, আমেরিকা, রাশিয়া ও বেরিং প্রণালী) একসাথেই আছে। সুতরাং যারা এটা দিয়ে বলাকার পৃথিবী প্রমানের চেষ্টা করেন, তারা এখনো ভুলের মধ্যেই আছেন। আর যারা এই ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন, আশা করি তাদের কনফিউশন দূর হলো।
zazkallah khairan
ReplyDelete