মহামারী ব্যাখ্যায় মুসলিম বোঝাপড়া
মুসলিম সভ্যতায় মহামারীর প্রকোপের সময় এই কেন্দ্রিক নানা রকমের প্রশ্ন সামনে আসতো। যেহেতু মহামারী কেন্দ্রিক বিস্তারিত গবেষণার ইতিহাস খুব বেশী দিনের নয়, তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার আগে এ নিয়ে নানারকমের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস কাজ করতো। এতে সন্দেহ নেই যে, করোনা ভাইরাস প্রধানত স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়, তবে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়েরও দার্শনিক ব্যাখ্যা থাকা জরুরী। একদিকে এতে যেমন মহামারী কেন্দ্রিক অন্ধ ও অপবিশ্বাস রোধ করা যাবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিজস্ব ভূমিকায় জোর দেওয়া যাবে, তেমনি মহামারীর স্বাস্থ্য বিপর্যয়কে বৃহত্তর দার্শনিক অবস্থান ও বিশ্বদৃষ্টির আলোকেও ব্যাখ্যা করা যাবে।
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। সেকেন্ডেই পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তের সংবাদ অপরপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। এতে যেমন সত্য সংবাদ থাকছে, তেমনি এর সাথে থাকছে নানারকমের ভুল, প্রান্তিক ও বানানো তথ্যও। তাতে প্যানিক ছড়ানোর ব্যাপক আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বস্তুত বিশেষজ্ঞদের মতে মহামারীতে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তথ্যের নিয়ন্ত্রণও জরুরী। নয়তো সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা আছে। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসে আমরা এর সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি।
সর্বোপরি করোনা ভাইরাসের আক্রমণকে নৈতিকভাবে কীভাবে বিচার করা হবে, সেই প্রশ্নও আসছে। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে চাইনিজদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ উঠছে, আবার অনেক মুসলমান একে চীনের উইঘুর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় অবতীর্ণ আজাব হিসেবে দেখতে চান, তবে মুসলিম বিশ্বে একই আজাব কীভাবে আসলো সেই প্রশ্নও উঠে যায়। মোটকথা এই করোনা ভাইরাস স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় হলেও এতে অনেক নৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্ন থেকে যায়। মুসলিম সভ্যতায় মহামারী বুঝাতে অবা ও তাউন শব্দ ব্যবহার করা হয়। এই লেখায় আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে অবা-তাউন বা মহামারীর ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা করবো।
নবীজির বয়ানে মহামারী
নবীজির বয়ানে মহামারীকে যুগপৎভাবে রহমত ও আজাব উভয়ভাবেই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একে নিছক সুনির্দিষ্টভাবে রহমত বা আজাব বলা হয়নি, বরং নবীজির ইরশাদে বুঝা যায়, প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মহামারীর ব্যাখ্যায় ভিন্নতা আসবে। এ হিসেবে মহামারীকে ফিতনা হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। পরীক্ষার্থী ও বিশ্বাস ভেদে এই ফিতনাকে রহমত ও আজাব হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
নবীজি বলেন,
الطاعونُ شهادةٌ لأُمَّتي ، و رحمةٌ لهم ، و رِجسًا على الكافرين
‘মহামারী আমার উম্মতের জন্য শাহাদাত ও রহমত আর কাফেরদের জন্য আজাব।’ ( মুসনাদে আহমদ ও তাবরানী )
মুহাদ্দিসীনে কেরাম এর নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন ; আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রাহঃ বলেন, যারা বিশেষ কঠিন অসুস্থতায় মারা যান, তাদের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা এতে বিশেষ কষ্ট ও অসহায়ত্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার বিনিময়ে মোমিনকে আল্লাহ শাহাদাত দান করেন। মৃত্যুর আগেই তার গুনাহ মাফের ব্যবস্থা করে দেন। ফলে মহামারী তার জন্য রহমত হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে কাফেরের মধ্যে যেহেতু ইসলামি বিশ্বদৃষ্টির বিশ্বাস থাকে না, তাই তার জন্য মহামারী অতিরিক্ত আজাব হিসেবে বিবেচিত হয়।
উল্লেখিত ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাকদির পূর্ব নির্ধারিত, দুনিয়াকে মানুষের পরীক্ষা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, এর পাশাপাশি মানুষের বিপদ-আপদকে তার কর্মফল হিসেবে ধরা হয়। এভাবে দেখলে বুঝা যাবে যে, মহামারী মোমিনের জন্য তার পাপমোচন বা মর্যাদা বৃদ্ধিকরণের অংশ হিসেবে আর কাফেরের জন্য তার শাস্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়। ফলে রহমত, নেয়ামত ও পরীক্ষায় মহামারী ব্যাখ্যা ইসলামের মৌলিক ব্যাখ্যাপ্রকল্পের অংশ।
মূলত পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, তার কোন কিছুই অর্থশূন্য নয়। যারা বিশ্বাস করেন, সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশ ও নির্দেশনায় সংঘটিত হয়, তাদের কাছে কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন বা প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, সব ঘটনার নির্দিষ্ট পরম্পরা, যোগসূত্র ও উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেক ঘটনাই নির্দিষ্ট বার্তা ও ইশারা বহন করে। ইসলাম পৃথিবীতে সংঘটিত ঘটনাসমূহকে ব্যাখ্যার জন্য কোরআন ও হাদিসে নির্দিষ্ট কিছু সূত্র ও মূল্যবোধ বর্ণনা করেছে। একেই আমরা ইসলামি নৈতিক অবস্থান ও বিশ্বদৃষ্টি হিসেবে আখ্যা দিয়েছি।
এই মৌলিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি নবীজি কোন কোন মহামারীতে জীনের প্রভাব থাকার কথাও বলেছেন। তবে এই হাদিস নির্দিষ্ট মহামারীর সাথে নাকি সকল মহামারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে নিয়ে হাদিসের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হাদিসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একে নির্দিষ্ট মহামারীর সাথে সংযুক্ত করাই শ্রেয়। কেননা ঐ হাদিসে বলা হয়েছে, আমার উম্মতের ধ্বংস হবে হত্যা ও মহামারীতে। অনেক মুহাদ্দিসের মতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরাম। কেননা সাহাবায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য অংশ যুদ্ধে বা মহামারীতে শাহাদাত বরণ করেছেন।
অবশ্য এখান থেকে আমরা মহামারীর মিশ্র কারণের সন্ধান পাই। প্রত্যেক রোগের ঔষুধ আছে, এই হাদিসের ভিত্তিতে যেমন আমরা মহামারীর চিকিৎসা বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা খুঁজবো, তেমনি দুষ্ট জীনের প্রভাবের কথা মাথায় রেখে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করবো। এ ছাড়াও চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হাদিসে শয়তান বা দুষ্ট জীনকে অপরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুর অর্থে ব্যাখ্যা করারও ব্যাপক প্রচলন আছে। অবশ্য এটি রুপক অর্থ। বিশেষ প্রমাণ ছাড়া রুপক অর্থগ্রহণ অনুচিত। তবে মহামারীর সাথে জীনের সম্পর্কের প্রশ্নে উল্লেখিত তিনটি বিষয় মাথায় রাখা যেতে পারে।
মহামারীর মোকাবেলা
উল্লেখিত ব্যাখ্যায় মহামারীর বিষয়ে ইসলামের নৈতিক অবস্থান পাওয়া গেলেও এর মোকাবেলার কর্মপদ্বতি বিবৃত হয়নি। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও এ নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে সংশয় ছিল। উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. এর যুগে, ৬৪০ খৃস্টাব্দে সিরিয়ায় আমওয়াস মহামারী সংঘটিত হয়। যাতে আবু উবাইদাহ বিন জাররাহ রাদি. এর নেতৃত্বে মুসলিম ফৌজও মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে যায়। ভাষণরত অবস্থায় মারা যান সেনাপতি আবু উবাইদাহ বিন জাররাহ রাদি.। পরবর্তীতে মুয়াজ বিন জাবাল রাজিঃ নেতৃত্বের ভার হাতে নিলে তিনিও মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।
এই পরিস্থিতিতে কী করা যাবে, সে নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। কেননা বাহ্যিকদৃষ্টিতে যেহেতু সে অঞ্চলে মহামারীর প্রকোপ ঘটেছে, তাই ঐ ভূমি ত্যাগ করাই শ্রেয়। উমর রাদি. থেকেও এই নির্দেশনা জারি হয়। তবে পরবর্তীতে নবীজির মহামারী বিষয়ক নির্দেশনা জানা যায় যে, যদি কোন অঞ্চলে মহামারী সংঘটিত হয়, তাহলে সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না, বাইরের লোকেরা সেখানে প্রবেশও করতে পারবে না। এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে মহামারীর স্বরূপ নিয়ে আলোচনা ও মোকাবেলার উপায় নিয়ে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়।
বস্তুত এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতেও মহামারী আক্রান্ত অঞ্চলে অবস্থানরতদের সেখানে অবস্থান করাই প্রতিরোধের উত্তম উপায়। বহিরাগতরাও আক্রান্ত অঞ্চল থেকে দূরে থাকলে মহামারীর বিস্তার রোধ করা যাবে। পাশাপাশি হাদিসের মধ্যে অসুস্থদের সাথে সুস্থদের রাখার বিষয়েও নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়। এছাড়াও পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে নবীজির নির্দেশনা আছে। এভাবে মহামারী বিস্তার রোধে ইসলামের বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে।
মহামারী ঠিক কী ও কেন ?
গ্রীকো-খ্রিস্টান সভ্যতায় মহামারী ব্যাখ্যায় ভাব ও বস্তুবাদী বয়ান চালু ছিল। ভাববাদী বয়ানে মহামারীকে গ্রহ-নক্ষত্রচক্রের চলাচলের প্রভাব হিসেবে আখ্যা দেওয়া হত। আরব মুশরিকদের মধ্যেও এই ব্যাখ্যাপ্রবণতা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। তারা যে কোন বিশেষ ঘটনাকে গ্রহ-নক্ষত্রের অলৌকিক আছর হিসেবে ব্যাখ্যা করতো। খোদ বাংলাদেশেও মহামারীর সাথে ওলা বিবির অভিশাপকে সংযুক্ত করা হত। খোদ পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান হিপক্রেটিসের ( Hippocrates ) থেকেও এই মত পাওয়া যায়।
এর পাশাপাশি গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞানী জালিয়ানুস ( Galen ) এর মতে মহামারী দূষিত আদ্রতা ও বাতাস থেকে সৃষ্টি হয়। গ্রীকপন্থী মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে এই মত ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। এর মধ্যে ইবনে সিনা, ইবনুন নাফিস ও ইবনে খাতিবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তাদের মতে নগর সভ্যতার বিকাশে দূষণ বৃদ্ধি পায়। যার প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশে দূষিত আদ্রতা ও দুর্গন্ধ থেকে শরীর ও মানসিক অবস্থায় ক্রিয়া ঘটে, যার থেকে সৃষ্টি হয় নানারকম মহামারী।
কোরআন ও হাদিসের মধ্যে মহামারী ঠিক কী, তার স্বরূপ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না। না পাওয়া যাওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। কেননা ইসলাম তো বিজ্ঞান নয়, ইসলাম ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থা। তবে অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার রোধে ইসলামের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ইসলামের অনুপ্রেরণায় আলেমদের ভূমিকাকে বিজ্ঞান না বলা গেলেও বিজ্ঞানমূলক হিসেবে আখ্যা দিতে হবে। গ্রীক প্রভাবিত মুসলিম ও মুসলিম রাষ্ট্রভুক্ত খ্রিস্টান-ইহুদী চিকিৎসক-দার্শনিকদের মধ্যে মহামারী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্রচক্রের ভূমিকার স্বীকৃতির কথা পাওয়া যায়। তবে মুসলিম আলেম ও চিন্তাবিদরা একে কঠিনভাবে খারিজ করেছেন।
তবে দূষিত আবহাওয়ার কারণে মহামারী ছড়ায়, এ মতকে মুসলিম চিন্তাবিদদের একাংশ আংশিকভাবে মেনে নিয়েছিলেন। ইবনে খালদুন থেকেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম ও চিন্তাবিদদের মধ্যে এই ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় জারি ছিল। ইবনে সিনা দূষিত আবহাওয়ার আগমনচিহ্ন হিসেবে জমিনের ভেতর থেকে পোকামাকড়ের বেরিয়ে আসার কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি জাকারিয়া কাযবীনী খলিফা হিশাম বিশেষ পোকা থেকে বাঁচতে অবস্থানস্থল ত্যাগ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
অবশ্য অনেক ফুকাহা ও মুহাদ্দিস আবহাওয়া দূষণকে মহামারীর কারণ হিসেবে আখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা এর পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দিয়েছেন। তাদের মতে নির্মল পরিবেশেও মহামারী সংঘটিত হয়, পাশাপাশি যদি খোদ বায়ু দূষণের কারণে মহামারী ঘটে থাকে, তাহলে সকল মানুষ ও প্রাণী এতে আক্রান্ত হবার কথা। অথচ দেখা যায়, এক শহরের মধ্যে কিছু মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন, বাকিরা বেঁচে যাচ্ছেন, আক্রান্তের পাশের ঘরের মানুষও এর থেকে বেঁচে যাচ্ছেন। এই সংশয়ের কারণে তারা মহামারী বিষয়ক গ্রীক দুই ব্যাখ্যাকেই নাকচ করেছেন। কখনো এই মতানুসারীদের তাকফীরও করেছেন।
তবে তাদের মধ্যে জীনের প্রভাবে মহামারী ছড়ায়, এমন একটি মতও জনপ্রিয় ছিল। এর ভিত্তি বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. এই দুইমতের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। তার মতে যেহেতু জীনের আক্রমণ অভিজ্ঞতা বা বাহ্যিক বুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয় নয়, তাই চিকিৎসকদের পক্ষে জীনের প্রভাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, পাশাপাশি জীনের আছরের ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও হয়তো তার সামনে ছিল। জীনের আছরকে মূল কারণ ও আবহাওয়া দূষণকে তার উপসর্গ হিসেবে বিবেচনার সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ইবনে হাজার রাহ.।
মোটকথা মুসলিম সভ্যতায় মহামারী বিষয়ক গ্রীকো-খ্রিস্টান সভ্যতার অনুমানের প্রভাব থাকলেও ধর্মীয়ভাবে এর ব্যাপক সমালোচনা ও পর্যালোচনা হাজির ছিল। প্রত্যেক রোগের ঔষুধ আছে, এই হাদিসে যেমন মহামারীর ঔষুধ অনুসন্ধানের প্রতি উৎসাহ ছিল, তেমনি ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের কঠোর সমালোচনাও জারি ছিল। এই দুইয়ের সমন্বয়ে মুসলিম সভ্যতায় মহামারীর কী ও কেন, এই দুই প্রশ্নের বোঝাপড়া আলোচিত হয়েছে।
মহামারী কি ছোঁয়াচে ও সংক্রামক ?
আমরা এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের দোহাইয়ে জানি যে, মহামারী নানামাত্রিকভাবে ছোঁয়াচে ও সংক্রামক হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে ইসলামি ইতিহাসে এ বিষয়ে বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে নবীজির সরাসরি কোন হাদিস না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কিছু হাদিসের ব্যাখ্যায় কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে ইসলামি সভ্যতার মহামারী বিষয় চিন্তা ও অবস্থান স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে।
নবীজির হাদিসের সূত্রে আমরা জানি যে, মহামারী আক্রান্ত স্থানে প্রবেশ করা যাবে না, আবার বাহিরও হওয়া যাবে না। এই হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, মহামারীর মধ্যে সংক্রমণ ও ছোঁয়াচে হবার গুণ রয়েছে। পাশাপাশি অন্য হাদিসে আছে, ইসলামের দৃষ্টিতে কোন সংক্রামক বলে কিছু নেই। এই দুই হাদিসের বাহ্যিক ভিন্নতায় আলেমদের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যায়।
তবে ইবনে হাজার ও তাজুদ্দিন সুবকীর মধ্য দিয়ে এই বিতর্কের এক রকম নিরসন ঘটে। তাদের মতে, স্বাভাবিকভাবে সংক্রমণের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হচ্ছে, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে সৃষ্ট সংক্রমণ ও স্বয়ংসক্ষম সংক্রমণ। দুটিতেই শেরেকি আছে। কেননা গ্রহ-নক্ষত্র আল্লাহর বিকল্প হিসেবে মানুষের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ভূমিকা রাখে, এটা তো সরাসরি জাহেলি কথা। পাশাপাশি কোন রোগ যদিও সংক্রমণের সক্ষমতা রাখে, তবে সেটা আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতা, আল্লাহ চাইলে তার এই সক্ষমতা ঠেকিয়ে দিতে পারেন। তবে আল্লাহর সুন্নত হচ্ছে, মহামারীর সংক্রমণ।
মহামারী : ইসলামের নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক অবস্থান
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, মহামারী বিষয়ে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নৈতিক অবস্থান আছে এবং তাতে কোন অস্পষ্টতা নেই। পাশাপাশি মহামারী মোকাবেলা বিষয়েও ইসলামের কার্যকর বক্তব্য আছে। তবে মুসলিম সভ্যতায় মহামারীর স্বরূপ ও সংক্রমণ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক জারি ছিল। যেহেতু স্বরূপের প্রসঙ্গ অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক ও বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন,তাই এর সমাধান ধর্মীয় বিষয় নয়। তবে মুসলিম চিন্তাবিদগণ ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে গ্রীক মহামারী ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা জারি রেখেছিলেন।
পাশাপাশি সংক্রমণের প্রশ্নেও অভিজ্ঞতার আলোকে এর বাস্তবতার ফতোয়াও চলে এসেছিল। তারা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝতে পেরেছিলেন যে, নবীজির মহামারী বিষয়ক বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী হাদিসের ব্যাখ্যায় আরও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। তাই মুসলিম অভিজ্ঞতায় মহামারীর স্বরূপের বুঝাবুঝিতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি না হলেও কোন কুসংস্কার বা অপবিজ্ঞানের চর্চা হয়নি। যদিও আজকাল ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে মহামারীর সংক্রমণ বিষয়ে মুসলিম অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় না। তাজুদ্দিন সুবকি নয়, তার অনেক পরের Girolamo Fracastoro কে তারা সংক্রমণ তত্ত্বের আবিষ্কারক বলে অভিহিত করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রগতি মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। ফলে গত চার পাঁচশো বছরে মহামারী বিষয়ে ইউরোপিয়ান বিশেষ অবদান ও আবিষ্কারের বিস্তার লক্ষ করা যায়। তবে ধর্ম হিসেবে ইসলাম অন্য সকল বিষয়ের মতো মহামারী বিষয়ক মৌলিক নৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম, মানব সভ্যতার ধারাবাহিক অজ্ঞানতা, অসাম্য, অনৈতিকতা ও কুসংস্কারের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব কখনোই কম নয়। এই নৈতিক, দার্শনিক ও বিশ্বদৃষ্টিকেই তো ধর্ম বলে।
সূত্র
১) বাযলুল মাউন ফী ফাজলিত তাউন।
২) আত তাউন ফিল আসরিল উমাবী
ইফতেখার জামিল
Comments
Post a Comment