মুসলমানদের শক্তিশালী গুপ্ত সংগঠন: দ্য হোয়াইট বেয়ার্ডস বা সাদা দাড়িওয়ালা
গুপ্তচর কিংবা গােপন সংগঠন কথাটি শুনলেই বর্তমান প্রজন্মের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইলুমিনাতি, ফ্রি ম্যাসন, দ্য হসপিটালার অথবা নাইটস টেম্পলারসহ বহু গােপন সংগঠনের নাম।যারা বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক কারণে গঠিত হয়েছিলাে।সেসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে ছিলাে তাদের অটুট ও একান্ত পালনীয় কিছু নীতি ও উদ্দেশ্য। যা কোনােসময়ই তারা সাধারণ মানুষদের কাছে প্রকাশ করতাে না। আমরা যেহেতু মুসলমান সেহেতু একজন মুসলিম হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মুসলমানরা ইতিহাসে গােয়েন্দা কার্যক্রমে অনেক সমৃদ্ধ ছিলাে। তাহলে মুসলমানদের কি কোনাে গুপ্ত সংগঠন ছিলাে না? হ্যাঁ ছিলাে। আর তার ইতিহাসও অনেক রােমাঞ্চকর।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রশিদুদ্দিন হামদানি উল্লেখ ক রেন, দেদে কুরকুত নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি জাতিতে ওঘুষ তুর্ক ছিলেন এবং নবীজী (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং দ্বীন ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যখন নবীজী এর সাক্ষাতে ছিলেন
তখন তিনি কসতুনতুনিয়া বা কনস্ট্যান্টিনােপল বিজয় সংক্রান্ত সুমহান সেই হাদীসটি শুনছিলেন। নবীজী ( সঃ)
বলেছিলেন “নিশ্চিতরূপেই তােমার কুসতুনতুনিয়া (কনস্টান্টিনােপল) জয় করবে। সুতরাং, তার শাসক কতই না উত্তম হবে এবং জয়লাভকারী সৈন্যরা কতই না উত্তম হবে। নবীজীর হাদীসটি শুনে তিনি তার বসতিতে ফিরে যান এবং তৎকালীন ওঘুষ শাসককে অবহিত করেন। এরপর থেকে নবীজীর হাদীসের আলােকে কনস্ট্যান্টিনােপল বিজয়কে নিজেদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নেয় এবং সেই মহিমান্বিত বিজয়কে তারা তুর্কি জাতির উপর বাধ্যতামূলক করে নেয়। আর সেই মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে মুসলমানদের একটি গােপন সংগঠন। যাদেরকে ইতিহাস স্বরণ করে হােয়াইট বেয়ার্ডস সাদা দাড়িওয়ালা নামেই। ইতিহাসে আকসাকাল, হেয়েত এবং ইহতিয়ারলার সহ আরাে বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন নামে এই সংগঠনকে স্বরণ করা হয়েছে। আকসাকাল অর্থ হলাে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান বৃদ্ধ ব্যক্তি। ওঘুষ সংস্কৃতিতে জ্ঞানী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের 'সাদা দাড়িওয়ালা’ হিসেবে অভিহিত করা হতাে।
আলােচ্য সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়েছিলাে ৬৮০ সালে মেটে হান নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে। মুসলমানদের গােপন এই
সংগঠনটি তৈরী হওয়ার পর ওঘুষ তুর্কিদের নেতারা নিজেদের বসতি থেকে জ্ঞানী ও মেধাবী বালকদের বাছাই করে সাদা দাড়িওয়ালা ব্যক্তিবর্গের নিকট পাঠাতেন। পরবর্তীতে সাদা দাড়িওয়ালাদের সংস্পর্শে থেকে সেই সকল বালকরা এক একজন তুখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতেন এবং তুর্কি সংস্কৃতি ও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার ময়দানে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খিদমত করতাে। খ্রিষ্টান কিংবা অন্যান্য শত্রুদের থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করতাে এবং ওঘুজ নেতাদের তা অবহিত করতাে।শত্রুদের সমাজ, সংস্কৃতির সাথে মিশে যাবার জন্য একদম ছােট বয়সেই গােয়েন্দা নিয়ােগ করার ইতিহাসও পাওয়া যায়। এই বালকেরা বড় হতে হতে শত্রুদের কৃষ্টি, সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যেত, এর ফলে তথ্য সংগ্রহ করার কাজও অনেক সহজ হয়ে যেতাে।বাছাইকৃত বালকদেরকে নিয়ে সাদা দাড়িওয়ালারা
গঠন করত শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। আর সৈন্য বাহিনী থাকত চার স্তরে বিভক্ত। প্রথম ভাগে থাকত আকিনজিরা, যারা ছিল ঘােড়সওয়ার এবং তারা যুদ্ধের সর্বোচ্চ ঝুঁকি মােকাবেলা করত। এরপর আসত দেলাইলার বা স্পেশাল ফোর্স। এদেরকে সুইসাইড স্কোয়াড বা গেরিলা যােদ্ধা বলেও অভিহিত করা যায়। এদের কাজ ছিল ময়দানের কোথাও কোনাে ঘাটতির তাৎক্ষণিক মােকাবিলা কিংবা হঠাৎ আক্রমণ করে শত্রুপক্ষকে আতঙ্কিত করে দেওয়া। তৃতীয় স্তরে থাকত আল্পস বা সাধারণ সৈন্যগণ। যারা যুদ্ধের মধ্যে যেকোন আদেশ পালন করত। চতুর্থ বা সর্বশেষ স্তরেই পাওয়া যেত সাদা দাড়িওয়ালাদের। যুদ্ধের গােয়েন্দা কার্য
ক্রম থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সার্বিক সহযােগিতা করত তারা।
সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে খােদ
সুলতানকেও তারা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। বিভিন্ন
সময়ে বিখ্যাত দরবেশরাও তাদের সাথে কাজ করতেন।
তন্মধ্যে আখি এভরান (রহঃ) সর্বাধিক পরিচিত। তার নামে
পরবর্তী সময়ে একটি ধারার সৃষ্টি হয় এবং সেই ধারার
অনুসারীদের আখি বলে ডাকা হত। আখি’ শব্দের অর্থ- আমার ভাই। এই আখিরা উসমানী খেলাফতের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ভাই। এই আখিরা উসমানী খেলাফতের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছিলেন। ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা, সততার ধারণা তাদের মাধ্যমে পুরাে খেলাফতে বিস্তার লাভ করেছিল। ইতিহাসে মুসলমানদের যে দুটি বিখ্যাত ও শক্তিশালী সালতানাত (সেলজুক ও উসমানীয়) গঠিন হয়েছিলাে তার পেছনে এই সাদা দাড়িওয়ালা সংগঠনের অসামান্য অবদান ছিলাে। মহান সেলজুক সালতানাত এবং উসমানী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সাদা দাড়িওয়ালারা বিশাল অবদান রেখেছেন। তারা সবসময় পরামর্শ, শত্রুদের থেকে সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
দিয়ে সালতানাতকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতেন।উসমানী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজী, তার পিতা এরতুগরুল গাজীকে তারা সবধরনের সামরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তারা কখনাে প্রকাশ্যে আসতেন না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গােয়েন্দা কার্যক্রমে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন। উসমানী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজী সহ তার পিতা এরতুগরুল গাজী এবং দাদা সােলায়মান শাহের সাথেও সাদা দাড়িওয়ালাদের সম্পৃক্ততার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। মধ্য এশিয়া, খােরাসান, ককেশাস অঞ্চলে যখন মঙ্গোলদের তাণ্ডব মাথাচাড়া দিল, তখন সাদা দাড়িওয়ালাদেরকে প্রচুর পরিমাণে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ ধারণা করা হতাে যে, তারা মুসলমানদের প্রতিরােধের সর্বোচ্চ পর্যায়। কায়ি বসতির নেত সােলায়মান শাহ মঙ্গোলদের আক্রমনের শিকার হয়ে খোরাসান। কায়ি বসতির নেতা সােলায়মান শাহ মঙ্গোলদের আক্রমনের শিকার হয়ে খােরাসান থেকে আনাতােলিয়ায় বসতি স্থাপন করেন এই সাদা দাড়িওয়ালাদেরই পরামর্শে। সাদা দাড়িওয়ালাদের লােগাে বা প্রতীক ছিল তিনটি চাঁদ, একটির সাথে অপরটি জোড়া দেওয়া। সাধারণত দৃষ্টি পড়ে এরকম স্থানে প্রতীকটি ব্যবহার নিজেদেরকে প্রকাশ করত তারা।
ইতিহাসে তাদের সত্যতার অনেকগুলাে প্রমাণের মধ্যে একটি হল ১৪৫২ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ, যিনি আল ফাতিহ
মুহাম্মদ নামে সুপরিচিত, যার নেতৃত্বে রাসূল (সাঃ) এর
ভবিষ্যদ্বাণী- কনস্টান্টিনােপল বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল, তিনি
একটি প্রাসাদের নকশা আঁকেন। এ নকশার সাদৃশ্য ছিল সাদা দাড়িওয়ালাদের তিন চাঁদওয়ালা প্রতীকের সাথে। প্রাসাদটি চানাক্কালে প্রাসাদ বা কিলিতবাহির প্রাসাদ নামে সুপরিচিত । ধারণা করা হয়, সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনােপল বিজিত হবার পরে তারা কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলেন; কারণ তাদের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল কনস্টান্টিনােপল বিজয়ের জন্য কাজ করে যাওয়া। উসমানী খেলাফতের ক্রান্তিকালে যখন সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ মসনদে ছিলেন, তখন একই রকমের একটি সংগঠন
আবার তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।তৎকালীন উসমানী খেলাফত আশেপাশের অন্য রাষ্ট্রগুলাে থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল এবং ইসলামী ভাবধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্য ভাবধারায় দীক্ষা নেবার খুব প্রবণতা দেখাগিয়েছিল। সুলতান এরকম সংগঠন করার জন্য তখন যােগ্য লােকও পাননি এবং সফল হতে পারেননি।
মূলত, সাদা দাড়িওয়ালারা ছিলেন একটি বৃহৎ স্বপ্নের ধারক
এবং বাহক। বহু বছর ধরে তারা সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে এসেছিলেন। তুর্কিদের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তাকে তারা সমৃদ্ধ করেছিলেন এবং নিজেদেরকেও রেখেছিলেন লােকচক্ষুর আড়ালে।
কার্তেসী-
1. জামি আল তাওয়ারিখ, দ্য রাশীদুদ্দিন হামদানী অব সেলজুক তুর্কস,
2.https://www.historicales.com/who-were-white-beards-or.../...
3.https://youtu.be/mRNIgQg5t...
4.https://muslimsaltanat.net/
(Collected & Edited)
R:M: ইসলামে এ ধরনের প্রতিক ব্যবহারের অনুমতি নেই। অর্ধ চাঁদ হচ্ছে ভাগ্য দেবি মানাতের প্রতিক। সুতরাং, এটাকে আবার কেউ দলিল হিসেবে নিয়েন না। এরকম অনেক প্রতিকই মুসলমানদের মধ্যে ভুল বশত ঢুকে গেছে। যেমনঃ চাদ-তারা ইত্যাদি।
Comments
Post a Comment