ইখওয়ান-আস সাফা: মধ্যযুগে জ্ঞানচর্চার গুপ্ত সংগঠন
৯৮০-৮২ সালের দিকে বসরা কেন্দ্রিক একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। তাদের ‘ইখওয়ানুস সাফা’ বা ‘সততার অনুসারী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাদের পুরো নাম ‘ইখওয়ানুস সাফা ওয়া খুল্লানাল ওয়াফা ওয়া আহলুল-হামদ্ ওয়া আবনাউল-মাজদ্’। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ, বিশ্বস্ত সুহৃদ, প্রশংসিত পরিবার এবং মহত্ত্বের সন্তানগণ’। সংক্ষেপে পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ বা ইখওয়ান আস সাফা বলা হয়। প্রথমদিকে ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে তারা আবির্ভূত হলেও ক্রমেই দর্শনের দিকে ঝুকে পড়ে এবং দার্শনিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে তাদের কার্যকম রহস্যের চাদরে ঢাকা। গোপন রাখা হতো ব্যক্তি বিশেষের পরিচয়৷ ধারণা করা হয় এই গুপ্ত দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নামকরণ করা হয় আবদুল্লাহ ইবনে আল মুকাফফার লেখা “কালিলা ওয়া দিমনা” গ্রন্থের বন্য কবুতরের কাহিনী হতে।
একঝাঁক কবুতর শিকারির ফাঁদে আটকে পড়লো। ফাঁদ থেকে মুক্তির অন্য উপায় না পেয়ে সবাই মিলে জালসহ উড়ে গেলো এক ইঁদুরের কাছে। ইদুর জাল কেটে কবুতরদের মুক্ত করে দিলো। ইদুরের বন্ধুত্ব হলো কাক, কচ্ছপ এবং হরিণের সাথে। এর কিছুদিন পর হরিণটা এক শিকারির জালে আটকা পড়লো। ইদুর এসে যথারীতি মুক্ত করলো । দ্রুত পালাতে না পেরে শিকারির হাতে ধরা খেলো কচ্ছপ। হরিণ এগিয়ে গিয়ে শিকারীর মনোযোগ তার নিজের দিকে নিলো। এরপর ইদুর কচ্ছপকে মুক্ত করলো। এরপর থেকে এই প্রাণীর দলটা পরিচিতি পেলো “ইখওয়ান আস সাফা” বা পবিত্র ভ্রাতৃসংঘ হিসাবে।
এ সংগঠনের কার্যক্রম গোপন রাখা হতো। সদস্য সংগ্রহ ও হতো গোপনে। সদস্যদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। প্রথমটা ছিল শিক্ষানবীশ পর্যায়। ১৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বছরের যুবকরা এ স্তরের সদস্য হতো। তাদেরকে শিক্ষকের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও বাধ্যতার শিক্ষা দেয়া হতো।
দ্বিতীয় পর্যায়ের সদস্য ছিলো ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের ব্যক্তিগণ। যাদের বস্তুর সাদৃশ্য-আনুমানিক জ্ঞান ও পার্থিব শিক্ষা দেয়া হতো। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে প্রায়োগিক জ্ঞানও দেয়া হতো এদের। তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ৪০-৫০ বছরের ব্যক্তিরা বস্তুজগতে ঐশী বিধানাবলি অনুধাবনের চর্চা করতেন। সর্বশেষ পর্যায়ের সদস্যদের বয়স ছিল কমপক্ষে ৫০ বছর। এদেরকে মনে করা হতো যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারি। এটাই সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এবং দার্শনিকদের পর্যায়। দলের সদস্যরা গোপনে মাসে তিনবার তাদের প্রধান যায়েদ বিন রিফার ঘরে মিলিত হতো। সেখানে চলতো রাজনীতি, ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা। পবিত্র ভাতৃসংঘের সদস্যরা বিশ্বাস করতেন তৎকালীন ধর্মীয় বিধান ও কার্যাবলি ত্রুটিপূর্ণ। বিশুদ্ধ গবেষণার মাধ্যমে এ ভ্রান্তি ও ত্রুটি থেকে মুক্তি ও এতে সামঞ্জস্য আনা প্রয়োজন। তারা মনে করতেন ধর্ম সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু ধর্মের বাহ্যিক আবরণের অভ্যন্তরে যে দার্শনিক সত্য লুকায়িত, তা কেবল পণ্ডিত ব্যক্তিগণই বুঝতে পারেন।
পবিত্র ভ্রাতৃসংঘের বড় অবদান তাদের ‘রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফা’। ৫২টি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। এর মধ্যে ১৪টি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক, ১০টি অধিবিদ্যা, ১১টি সুফিবাদ ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক এবং বাকি ১৭টিতে প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, আবহাওয়াতত্ত্ব, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে। এছাড়া নীতিবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, মনোবিদ্যা এবং পারলৌকিক জীবন শাস্ত্র নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল তারই প্রতিফলন যেন এটা। সেকালের দর্শন ও বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কেউ কেউ এটাকে।
দর্শন ও চিন্তাধারাঃ
সংখ্যা তত্ত্ব
পিথাগোরিয়ানদের মত তারাও বিশ্বাস করতো প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুর প্রকৃতির সাথে সংখ্যার প্রকৃতির সাদৃশ্য আছে। তারা মনে করতেন,সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান হলো সংখ্যা। ধর্ম, ইতিহাস, ব্যাকরণ, কাব্য প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি জন্মালেই একজন সংখ্যাতত্ত্বের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে। গণিত হলো সংখ্যার বিশুদ্ধ বিজ্ঞান এবং গণিতের অংশ হলো জ্যামিতি। পিথাগোরিয়ানদের মতো এরাও নির্দিষ্ট কোন সংখ্যাকে গুরুত্ব দিতেন। যেমন তারা চারকে একটি বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন সংখ্যা মনে করতেন। এ গুরুত্বের উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করতেন চার ঋতু, চার দিক, চার ধরনের বস্তু উপাদান(আগুন, পানি,মাটি,বাতাস),চার ধরনের বাতাস। তারা মনে করতেন বস্তুকেও চার ভাগে ভাগ করা যায়। জগতকেও চারটি ঐশী নীতি বিদ্যমান। সেগুলো হলো স্রষ্টা, সার্বজনীন বুদ্ধিমত্তা, সার্বজনীন আত্মা ও মৌলিক জড়বস্তু।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
তারা মনে করতেন নক্ষত্র মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যে নক্ষত্রের প্রভাব বিদ্যমান। যেমন সৌভাগ্যের হেতু হলো বৃহস্পতি, শুক্র ও সূর্য। আর মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ হলো শনি,মঙ্গল ও চাঁদ। বুধ শিক্ষা ও বিজ্ঞানের জনক। শুক্র ঐশ্বর্যের প্রভাবক আর মঙ্গল দেয় সাহস ও মহত্ত্ব।
যুক্তিবিদ্যা
যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে এরা মূুলত এরিস্টটলকে অনুসরণ করেছেন। এদের মতে যুক্তিবিদ্যার স্থান অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার মধ্যখানে। পদার্থবিদ্যা আলোচনা করে বস্তুজগৎ নিয়ে। আর অধিবিদ্যায় আলোচিত হয় অতীন্দ্রিয় বিষয়। অপর দিকে যুক্তিবিদ্যা আত্মার নিজস্ব চিন্তা ও আত্মায় যে চিন্তা জন্মে উভয় নিয়েই আলোচনা করে।
সৃষ্টিতত্ত্ব
পবিত্র ভ্রাতৃসংঘের সদস্যদের মতে বস্তুজগত ও ঐশী জগতের উৎপত্তি পরম সত্য আল্লাহ হতে বিকিরণ এর মাধ্যমে। এরা এই বিকিরণ বুঝাতে গিয়ে সূর্যের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। আলো ও উজ্জ্বলতা যেমন সূর্য থেকে বিকিরিত হয়,তেমনি মহত্ত্ব ও সদগুণ ঈশ্বর থেকে বিকিরিত হয়। যে মহত্ত্ব ও সদগুণ ঈশ্বরের মধ্যে ছিল। জগত সৃষ্টির এ পক্রিয়া কয়েকটি ক্রমে সংঘটিত হয়।
১.স্রষ্টা
২.সৃজনশীল আত্মা
৩.নিষ্ক্রিয় আত্মা বা বিশ্ব আত্মা
৪. প্রথম উপাদান
৫.সক্রিয় প্রকৃতি
৬. দ্বিতীয় উপাদান
৭.মণ্ডল সমূহ
৮.চারটি পার্থিব উপাদান
৯.খনিজ পদার্থ, উদ্ভিদ ও প্রাণী
জগতকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলা হলেও, তা আসলে বিকিরনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছ। এছাড়াও দশম শতাব্দীর দিকে এরা বিবর্তনবাদের আভাসও দিয়েছিলো।
মনোবিদ্যা ও নীতিবিদ্যা
মানুষকে বলা হয় ক্ষুদ্র বিশ্ব। আর মহাবিশ্ব হচ্ছে বৃহৎ মানুষ। মানুষ এই জড়জগতের বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে অনুধ্যান। অনুধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানই হলো আত্মার প্রাণস্বরুপ। মানুষের জন্মের সময় তার আত্মা থাকে অলিখিত শ্লেটের মতো। অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে সে শ্লেট লিখিত হয়। তারা মনে করতেন ইতর প্রাণীদের মতো মানুষেরও ইন্দ্রিয় থাকলেও মানুষের স্বকীয়তা তার বুদ্ধিমত্তায়। এই বুদ্ধিমত্তাই ব্যক্তিকে সর্বোত্তম জীবন-যাপনে সহায়তা করে।
ভাতৃসংঘের নৈতিক আদর্শ হলো প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী চলা। মানুষের উচিত প্রাকৃতিক নিয়মকানুনে অনুগত থেকে বুদ্ধিময় জীবন যাপন করা। আর প্রজ্ঞার মাধ্যমেই মানুষ নীতিসম্মত জীবন-যাপন করতে পারে।
ধর্ম
ভাতৃসংঘের সদস্যরা নিজেদের মুসলিম ও ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করতো। তারা মনে করতো নামাজ,রোজা, হজ্ব,জাকাত ইত্যাদি লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম। কিন্তু অন্য পথেও সেটা অর্জন করা যায়। ধর্ম ও দর্শন, বিজ্ঞান ও জীবনকে সমন্বিত করে তারা বুদ্ধিমূলক ধর্মের ধারণা দেন। তারা মনে করতেন অনুষ্ঠানাদি নয় চিন্তা ও উপলব্ধির সাহায্যে ধর্মের যথার্থ তাৎপর্য বিকশিত হয়।
আধুনিক চিন্তাবিদদের অনেকেই ইখওয়ান আস সাফার লেখায় ইসমাইলীয় শিয়া মতবাদের গন্ধ খুঁজে পান। রিচার্ড নেট্টনের মতে,
ইখওয়ান আস সাফার কোরআন ও হাদিস ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিতে ইসমাইলীয় বাতেনি মতবাদের আমেজ আছে। (Muslim Neoplatonists, London, 1982, Page- 80)
কাছাকাছি প্রসঙ্গ তুলে এনে মারকুয়েট বলেন,
এ নিয়ে আসলে বিতর্ক করার অবকাশ নেই। তাদের লেখা সেই সময়কার ইসমাইলীয় মতবাদকেই প্রতিফলিত করে। (Encyclopaedia of Islam, 1960, Page- 1071)
এবং তারপর
বাগদাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ফাতেমীয়দের ভেতরেই বিভাজনের টানাপোড়েন, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রাদুর্ভাব প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতার কারণেই খুব বেশি অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। গোপন সংগঠন এবং প্রচুর অধ্যবসায়ের ভেতর দিয়ে টিকে থাকার মানসিকতাও হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক মতবিরোধমূলক আলোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে দার্শনিক জ্ঞানচর্চা উপেক্ষিত হতে থাকে। ইখওয়ান আস সাফাও সক্রেটিস, পিথাগোরাস, প্লেটো এবং এরিস্টটলের মতবাদ পর্যালোচনায় অতিমাত্রায় জোর দিয়ে নিজস্বতা হারিয়ে বসে। যার পরিণাম ইতিহাসের মঞ্চ থেকে তাদের প্রস্থান। এখন পর্যন্ত ইখওয়ান আস সাফার সংকলন রাসায়েলে ইখওয়ান আস সাফা- মধ্যযুগে মুসলিম(??) জ্ঞানচর্চার অন্যতম বিশ্বকোষ বলে গণ্য করা হয়।
(Collected)
R:M: এটা যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বহির্ভুত একটি ভ্রান্ত সংঘঠন, তা আমরা ভালো করেই বুঝতে পারলাম। সুতরাং এটাকে মুসলিম সংঘ মনে করাটা ভুল হবে। তবে যুগে যুগে অসংখ্য মুসলিম (বিশেষ করে মডারেট) এ ধরণের গুপ্ত বা ভ্রান্ত সংঘঠনের দর্শন বা কার্যক্রম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এবং সেগুলোকে (এসব গুপ্ত, ভ্রান্ত ও নিষিদ্ধ বিদ্যা) দলিল হিসেবে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে এসব ফেতনা থেকে হেফাজত করুন।
Comments
Post a Comment